পাকিস্তান ও তালেবানের সংঘাত ,পরিণতি কী?

 

২০২১ সালের আগস্টে তালেবান কাবুলে ক্ষমতা দখল করার পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী শেখ রশিদ আহমেদ আফগানিস্তানের তোরখাম সীমান্তে এক বিজয়োল্লাসপূর্ণ সংবাদ সম্মেলন করেন। রশিদ দাবি করেন যে তালেবানের ক্ষমতা দখল একটি নতুন কৌশল তৈরি করবে এবং এই অঞ্চলের বৈশ্বিক গুরুত্ব বৃদ্ধি করবে। পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান আফগানদের ‘দাসত্বের শৃঙ্খল ভেঙে ফেলা’ হিসেবে এই ঘটনাকে বর্ণনা করেছিলেন।

প্রায় ২০ বছর ধরে তালেবান একটি শক্তিশালী বিদ্রোহ পরিচালনা করেছে এবং এক সময় তারা ৪০টিরও বেশি দেশের সমন্বয়ে গঠিত মার্কিন নেতৃত্বাধীন জোটের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। এই সময়ের মধ্যে তালেবান নেতারা পাকিস্তানের আফগানিস্তান-সংলগ্ন অঞ্চলে আশ্রয় পেয়েছিলেন এবং কোয়েটা, পেশোয়ার ও করাচির মতো শহরগুলোতে তাদের উপস্থিতি প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

তালেবান নেতাদের অনেকেই পাকিস্তানের ইসলামি ধর্মীয় স্কুল থেকে স্নাতক, যার মধ্যে অন্যতম ছিল দারুল উলুম হাক্কানিয়া, যেখানে তালেবান আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা মোল্লা মুহাম্মদ ওমর পড়াশোনা করেছেন। পাকিস্তানের সমর্থন এবং আশ্রয়ের মাধ্যমেই তালেবানের বিদ্রোহ সফল হয়।

পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের সম্পর্ক অত্যন্ত জটিল। পাকিস্তান তালেবানের ক্ষমতায় ফিরে আসাকে স্বাগত জানালেও, তালেবান সরকার পাকিস্তানের প্রত্যাশা অনুযায়ী সহযোগিতা করেনি। পাকিস্তান আফগানিস্তানে জাতীয়তাবাদী বয়ান ব্যবহার করে বৃহত্তর আফগান সমাজের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করছে, কিন্তু তালেবান এখন আর অতিরিক্ত পাকিস্তানের ওপর নির্ভরশীল হতে চায় না।

ডুরান্ড লাইন, যা পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের মধ্যে সীমান্ত হিসেবে পরিচিত, এক আবেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ১৯৯০-এর দশকে তালেবান সরকার এই সীমান্তকে স্বীকৃতি দেয়নি এবং বর্তমান তালেবানও একই নীতি অনুসরণ করছে। পাকিস্তান এই অবস্থাকে নিজেদের কৌশলের প্রতি চ্যালেঞ্জ হিসেবে দেখছে।

তালেবান আফগানিস্তানে ক্ষমতায় আসার পর, সশস্ত্র বিদ্রোহের ক্ষেত্রটি পাকিস্তানে স্থানান্তরিত হয়েছে। এর ফলে, ২০২২ সাল থেকে পাকিস্তানের নিরাপত্তা বাহিনীর ওপর জঙ্গি হামলার ঘটনা বেড়েছে। এসব হামলার অধিকাংশের দায় তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান (টিটিপি) স্বীকার করেছে, যা পাকিস্তানি তালেবানের একটি শাখা।

পাকিস্তান আফগানিস্তানের সীমান্তে টিটিপি নেতাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানালেও, তালেবান তা গ্রহণ করবে না বলে মনে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আফগান ভূখণ্ডে বোমাবর্ষণ চালিয়ে যেতে পারে, যদিও তারা সামান্য আন্তর্জাতিক নিন্দার সম্মুখীন হবে। পাকিস্তান সরকার এই পদক্ষেপের মাধ্যমে তাদের অভ্যন্তরীণ সমস্যা চাপিয়ে রাখতে চাইতে পারে এবং একটি রাজনৈতিক বার্তা পাঠাতে পারে।

তালেবান বর্তমানে আন্তর্জাতিকভাবে একা, এবং তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। তবে, প্রশ্ন উঠছে, তারা কীভাবে পাকিস্তানের মতো শক্তিশালী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেবে, যারা তাদের দীর্ঘদিনের মিত্র ছিল?

পাকিস্তানের ওপর তালেবানকে প্রভাবিত করার আরও কিছু উপায় রয়েছে, যেমন আফগানিস্তানের অধিকাংশ বাণিজ্য পাকিস্তানের মধ্য দিয়ে হয় এবং পাকিস্তান বহু বছর ধরে আফগান শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়েছে। তবে পাকিস্তানি সামরিক অভিযানের ফলে আফগান জনগণের মধ্যে পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব বাড়বে, এবং পাকিস্তানি পশতুন জনগোষ্ঠী আরও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।

শক্তি প্রদর্শন হয়তো কিছু অস্থায়ী চমক সৃষ্টি করতে পারে, তবে শান্তি প্রতিষ্ঠা করতে হলে প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, দূরদর্শিতা এবং ধৈর্য। আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মধ্যে এক প্রজন্মের বেশি সময় ধরে রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং দূরদর্শিতার অভাবে দুই দেশের ৩০ কোটিরও বেশি মানুষের সমৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়েছে।

— হামিদ হাকিমি, চ্যাথাম হাউসের অ্যাসোসিয়েট ফেলো, সিএইচএস দোহা সিনিয়র ফেলো, আটলান্টিক কাউন্সিলের নন-রেসিডেন্ট সিনিয়র ফেলো

আল–জাজিরা

সূত্রঃ প্রথম আলো

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *