দীর্ঘ সময় ধরে চলা ১০ টি ঐতিহাসিক যুদ্ধ

যুদ্ধ কখনোই কোনো জাতির জন্য আশীর্বাদ হয়ে আসেনি। বরং এটি ব্যক্তি থেকে শুরু করে সমাজ এবং সভ্যতার ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলে। যুদ্ধের কারণে মানুষ যেমন জীবনের স্বাভাবিক ছন্দ হারায়, তেমনই ঘৃণা, প্রতিশোধ আর অসহিষ্ণুতার বিষবৃক্ষ ডালপালা ছড়ায়। ইতিহাসে এমন কিছু যুদ্ধ ঘটেছে, যেগুলো শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে চলেছে। দীর্ঘ সময় ধরে চলা এসব যুদ্ধ কেবল রক্তপাত নয় পুরো অঞ্চলের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক কাঠামোকে বদলে দিয়েছে। চলুন মানব ইতিহাসের সবচেয়ে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধগুলো সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক।

১. রিকনকুয়েস্টা (আইবেরীয় উপদ্বীপ পুনরুদ্ধার)

স্পেন ও পর্তুগালের খ্রিস্টান শাসকদের সঙ্গে মুসলিম শাসকদের সংঘর্ষ থেকেই শুরু হয় রিকনকুয়েস্টা। ৭১১ সালে মুসলিম বাহিনীর জিব্রাল্টার প্রণালী পাড়ি দিয়ে এই যুদ্ধের সূচনা হয়। তারা দ্রুতই পুরো স্পেন ও পর্তুগাল দখল করে নেয়। তবে খ্রিস্টান শাসকেরা ধীরে ধীরে শক্তি পুনর্গঠন করে এবং ১৪৯২ সালে গ্রানাডা পুনর্দখলের মাধ্যমে এ সংঘর্ষের সমাপ্তি ঘটে। এই যুদ্ধ টানা ৭৮১ বছর ধরে চলে যা ইতিহাসের দীর্ঘতম যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত।

২. রোমান-জার্মানিক যুদ্ধ (সভ্যতার সংঘর্ষ)
রোমান সাম্রাজ্য ও জার্মানিক গোত্রগুলোর মধ্যকার এই যুদ্ধের সূচনা ১১৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এই সংঘর্ষ পশ্চিম রোমান সাম্রাজ্যের পতনের মধ্য দিয়ে ৫৯৬ সালে শেষ হয়। প্রায় সাত শতকের এ যুদ্ধ কেবল সামরিক সংঘাতই ছিল না, বরং এটি ইউরোপের জনসংখ্যাগত ও সাংস্কৃতিক চিত্রও আমূল বদলে দেয়।

৩. অ্যাংলো-ফরাসি সংঘাত (ইউরোপের নিয়ন্ত্রণের লড়াই)
ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যকার এই লড়াই ১১০৯ সালে শুরু হয় এবং ১৮১৫ সালে ওয়াটারলুর যুদ্ধে নেপোলিয়নের পরাজয়ের মাধ্যমে শেষ হয়। সাত শতকের বেশি সময় ধরে চলা এ যুদ্ধের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় ছিল ক্রেসি ও এগিনকোর্টের মতো বিখ্যাত যুদ্ধগুলো। এটি শুধু ইউরোপ নয়, বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলেও এর প্রভাব ছড়ায়।

৪. রোমান-পার্সিয়ান যুদ্ধ (দুই প্রাচীন সাম্রাজ্যের সংঘাত)
রোমান ও পারস্য সাম্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধের সূচনা হয় ৫৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। এটি চলে ৬২৮ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত। দুই সাম্রাজ্যের সীমান্তে মেসোপটেমিয়া ছিল এই যুদ্ধের মূল কেন্দ্রবিন্দু। দীর্ঘ ছয় শতকের এই সংঘাত তাদের সামরিক কৌশল এবং প্রযুক্তিগত উদ্ভাবনগুলোকেও ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করেছে।

৫. বাইজেনটাইন-বুলগেরীয় যুদ্ধ (সীমানার পুনঃনির্ধারণ)
বুলগেরীয় শাসক খান আসপারুহ দানিয়ুব নদী পেরিয়ে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের ভূখণ্ড দখলের মধ্য দিয়ে ৬৮০ সালে এই যুদ্ধ শুরু হয়। ১৩৫৫ সালে বুলগেরীয় বিজয়ের মধ্য দিয়ে এ যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটে। তবে অল্প সময়ের মধ্যেই অটোমান সাম্রাজ্যের উত্থান উভয় পক্ষের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেয়।

৬. ক্রুসেড (ধর্মের নামে সংঘর্ষ)

১০৯৫ সালে শুরু হওয়া ক্রুসেড ইউরোপীয় খ্রিস্টান শাসকদের মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম-শাসিত অঞ্চল দখলের জন্য পরিচালিত অভিযানের ফল। এই লড়াই প্রায় ৬০৪ বছর ধরে চলে এবং ১৬৯৯ সালে শেষ হয়। এর প্রভাব কেবল যুদ্ধক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ ছিল না; বরং এটি সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় সম্পর্কেও দীর্ঘস্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসে।

৭. আরব-বাইজেনটাইন যুদ্ধ (ভূরাজনৈতিক বিভাজন)

৬২৯ সালে আরব শাসকদের সঙ্গে বাইজেনটাইন সাম্রাজ্যের যুদ্ধ শুরু হয়। প্রায় ৪২১ বছর ধরে চলা এই সংঘাত শেষ হয় ১০৫০ সালে। এ যুদ্ধ ইউরোপ ও মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে ভৌগলিক সীমারেখা নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে।

৮. ইয়েমেনি-অটোমান সংঘাত (আরব উপদ্বীপের দখলদারিত্ব)

১৫৩৮ সালে শুরু হওয়া এই সংঘাত ইয়েমেনের শাসকদের সঙ্গে অটোমান সাম্রাজ্যের লড়াই। ১৯১১ সালে চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধ শেষ হয়। তবে অল্প কয়েক বছরের মধ্যেই প্রথম বিশ্বযুদ্ধের প্রভাবে সেই চুক্তি কার্যত অকার্যকর হয়ে যায়।

৯. মরক্কো-পর্তুগাল সংঘাত (ভূমধ্যসাগরের দখলের লড়াই)

১৪১৫ সালে শুরু হওয়া এই যুদ্ধ শেষ হয় ১৭৬৯ সালে। পর্তুগালের সাম্রাজ্যবাদী পরিকল্পনা এবং মরক্কোর প্রতিরোধের মধ্যে টানা ৩৫৪ বছরের সংঘাত ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে ক্ষমতার ভারসাম্য নির্ধারণ করে।

১০. রাশিয়া-তুরস্ক যুদ্ধ (দুই সাম্রাজ্যের দখলদারিত্ব)

রাশিয়া এবং অটোমান সাম্রাজ্যের মধ্যে সংঘটিত ১২টি যুদ্ধকে সম্মিলিতভাবে রুশ-তুর্কি সংঘাত বলা হয়। এটি শুরু হয় ১৫৬৮ সালে এবং আনুষ্ঠানিকভাবে শেষ হয় ১৯১৮ সালে। প্রায় ৩৫০ বছর ধরে চলা এই যুদ্ধের চূড়ান্ত সমাপ্তি ঘটে ব্রেস্ট-লিটভস্ক চুক্তির মাধ্যমে।

দীর্ঘ সময় ধরে চলা এসব যুদ্ধ ইতিহাসে কেবল শাসক-শাসিতের লড়াই নয়; বরং এর প্রতিটি অধ্যায় বিভিন্ন সংস্কৃতি, জাতি এবং সভ্যতার বিকাশ ও পতনের সাক্ষী। এ যুদ্ধগুলো আমাদের ইতিহাসের পথচলায় মূল্যবান শিক্ষা রেখে গেছে, যা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ পৃথিবীর জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *