গাজায় গত ১৫ মাস ধরে চলমান সংঘাতের কারণে এক অভূতপূর্ব মানবিক বিপর্যয়ের সৃষ্টি হয়েছে। ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে সাম্প্রতিক যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও অঞ্চলটি এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর হামাসের আকস্মিক আক্রমণের জেরে এই সংঘাত শুরু হয়। সেই হামলায় প্রায় ১২০০ ইসরায়েলি নিহত হন এবং ২৫১ জনকে জিম্মি করা হয়।
জবাবে ইসরায়েল গাজায় ভয়াবহ সামরিক অভিযান শুরু করে যা এক বছরেরও বেশি সময় ধরে চলেছে। ফিলিস্তিনি স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী এই সংঘাতে ৪৬,০০০ এর বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। গাজার অবকাঠামো কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে।
নিহত ও আহতদের পরিসংখ্যান
গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের মতে সংঘর্ষে নিহতদের মধ্যে ৫৯ শতাংশই নারী শিশু ও বৃদ্ধ। জাতিসংঘের তথ্য মতে বাস্তব সংখ্যাটি আরও বেশি এবং নারীদের পাশাপাশি শিশুদের মৃত্যুহার ৭০ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে। এ পর্যন্ত ১ লাখ ১০ হাজারের বেশি মানুষ আহত হয়েছেন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে আহতদের মধ্যে ২৫ শতাংশের আঘাত এত গুরুতর যে তারা আর স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবেন না।
ধ্বংসস্তূপে গাজার অবকাঠামো
ইসরায়েলি হামলায় গাজার ৬৯ শতাংশ ভবন পুরোপুরি ধ্বংস বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে রাস্তাঘাটের ৬৮ শতাংশ এবং পানির লাইনসহ অন্যান্য সেবা-ব্যবস্থাও ধ্বংসপ্রাপ্ত। হাসপাতালের ৫০ শতাংশ বন্ধ হয়ে গেছে বাকি হাসপাতালগুলো সীমিত সেবা দিচ্ছে। আহত রোগীদের চিকিৎসা দেয়া এক বিরাট চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
ইসরায়েল বরাবরই অভিযোগ করেছে যে হামাস হাসপাতাল ও তার আশেপাশের এলাকা থেকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। কিন্তু বিশ্ব স্বাস্থ্য সংহিতা এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো হাসপাতাল ও স্বাস্থ্যকর্মীদের নিরাপত্তা না থাকা নিয়ে ইসরায়েলের সমালোচনা করেছে।
ব্যাপক বাস্তুচ্যুতি
গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০ শতাংশ মানুষ তাদের বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র যেতে বাধ্য হয়েছে। অনেকেই একাধিকবার স্থান পরিবর্তন করতে বাধ্য হয়েছে। জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী গাজার উত্তরাঞ্চলের প্রায় ৯০ শতাংশ এলাকা খালি করার নির্দেশ দেয়া হয়। এমনকি নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য নির্ধারিত এলাকাগুলোতেও বোমাবর্ষণ চালানো হয়েছে।
বর্তমানে খোলা মাঠে অস্থায়ী তাঁবুতে আশ্রয় নিয়েছে হাজার হাজার মানুষ। তীব্র ঠাণ্ডা ও অপ্রতুল আশ্রয়ের কারণে সেখানে চরম দুর্দশা দেখা দিয়েছে।
খাদ্য ও ত্রাণের সংকট
গাজার ৯১ শতাংশ মানুষ বর্তমানে তীব্র খাদ্য সংকটে ভুগছে। যুদ্ধের কারণে গাজার ৬৭ শতাংশ কৃষিজমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ৫০০ ট্রাক ত্রাণ গাজায় প্রবেশ করত এখন সেই সংখ্যা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে গেছে।
ত্রাণকর্মীরা জানিয়েছে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ভেঙে পড়ায় অনেক সময় অপরাধী চক্র ত্রাণ লুট করছে। জাতিসংঘের মতে প্রায় ১৯ লাখ মানুষ জরুরি খাদ্য আশ্রয় এবং চিকিৎসা সেবার প্রয়োজনীয়তার মুখে রয়েছে।
শিক্ষা ব্যবস্থার বিপর্যয়
গাজায় সংঘাতের ফলে শিক্ষা খাতও ভয়াবহ ক্ষতির শিকার হয়েছে। ইসরায়েলি বাহিনীর হামলায় গাজার বেশ কয়েকটি স্কুল ধ্বংস হয়েছে। জাতিসংঘ জানিয়েছে অনেক স্কুল বাস্তুচ্যুত মানুষের আশ্রয়কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে গাজায় স্বাভাবিক শিক্ষা কার্যক্রম পুনরায় শুরু করা বিশাল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে।
পুনর্গঠন: দীর্ঘমেয়াদি চ্যালেঞ্জ
জাতিসংঘ অনুমান করেছে গাজার ধ্বংসপ্রাপ্ত অবকাঠামো ও সেবা পুনর্গঠনে প্রায় ৪০ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এক বছরের বেশি সময় ধরে চলা সংঘাতের ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে গাজাকে অন্তত এক দশক সময় লাগবে।
গাজার বর্তমান পরিস্থিতি মানব ইতিহাসে অন্যতম ভয়াবহ সংকটগুলোর একটি। যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলেও মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসা এখনো বহু দূরের বিষয়। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দ্রুত ও কার্যকর সহযোগিতা ছাড়া এই সংকট উত্তরণ সম্ভব নয়।
গাজা পুনর্গঠনের কাজ শুধুমাত্র ইট-পাথরের পুনরুদ্ধার নয়; এটি একটি মানুষের অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করাই একমাত্র সমাধান।