অপ্রত্যাশিত এক মানসিক চাপের উৎস ডিজিটাল জঞ্জাল

অপ্রত্যাশিত এক মানসিক চাপের উৎস ডিজিটাল জঞ্জাল

আজকের ডিজিটাল যুগে, প্রযুক্তি আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাবলেট—এসব ডিভাইস ছাড়া আমাদের দৈনন্দিন কাজ কল্পনাও করা সম্ভব নয়। তবে এই প্রযুক্তি এবং তার অন্তর্গত ডিভাইসগুলোই অনেক সময় আমাদের মানসিক শান্তি বিঘ্নিত করতে পারে। আমরা যে ডিজিটাল বিষয়বস্তু প্রতিনিয়ত ব্যবহার করি, তা যদি একাধিক স্ক্রিনশট, অপঠিত ইমেইল, জমে থাকা নোটিফিকেশন, অপ্রয়োজনীয় ফাইল, কিংবা অন্য কিছু হয়ে থাকে, তা খুব সহজেই এক ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে। এটি যাকে বলা হয় ডিজিটাল জঞ্জাল।

এই ডিজিটাল জঞ্জাল শুধুমাত্র অস্থিরতা তৈরি করে না, বরং একটি গভীর মানসিক চাপের জন্ম দেয়, যা অনেকেই বুঝতে পারেন না। সাধারণত, যখন ফোন বা কম্পিউটার গিজগিজ করে থাকে নানা ধরনের অপ্রয়োজনীয় ফাইল, নোটিফিকেশন এবং ট্যাব দ্বারা, তখন এটি আমাদের মনকে বিশৃঙ্খল করে ফেলে।

বর্তমান বিশ্বের প্রখ্যাত মনোবিজ্ঞানীরা ডিজিটাল জঞ্জাল এবং মানসিক চাপের সম্পর্ক নিয়ে গভীর গবেষণা করেছেন। তাদের মতে, যারা তাদের স্মার্টফোনে জমে থাকা অপ্রয়োজনীয় ফাইল বা নোটিফিকেশন নিয়ে সমস্যায় পড়েন, তাদের মানসিক স্বাস্থ্যে বিঘ্ন ঘটতে পারে। ক্লিভল্যান্ড ক্লিনিকের মনোবিজ্ঞানী ডা. সুসান অ্যালবার্স বলেছেন, “যদি আপনি লক্ষ্য করেন যে ডিজিটাল বিষয়বস্তু নিয়ে মানসিক চাপ অনুভব করছেন বা অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা হচ্ছে, তবে বুঝতে হবে যে এটি আপনার জীবনে এক ধরনের ডিজিটাল বিশৃঙ্খলা তৈরি করেছে।”

অ্যালবার্স আরও বলেন, “প্রযুক্তির এই ভারী বোঝা আমাদের পূর্বপুরুষদের জীবনে ছিল না, তবে সময়ের সাথে সাথে ডিজিটাল ডিভাইসের বিস্তার আমাদের মানসিক স্থিতিশীলতার ওপর এক অজানা চাপ সৃষ্টি করছে।”

ডিজিটাল জঞ্জাল একদিকে যেমন মানসিক চাপ সৃষ্টি করে, তেমনি অন্যদিকে অনেকেই অপ্রয়োজনীয় ডিজিটাল বিষয়বস্তু জমিয়ে রাখেন ভবিষ্যতের জন্য। তবে, যখন এই সঞ্চিত তথ্যের পরিমাণ অস্বাভাবিক হয়ে ওঠে, তখন এটি “ডিজিটাল সঞ্চয়” নামে পরিচিত হয়ে ওঠে। এটি হতে পারে একটি ছবি, একটি ইমেইল, বা এমনকি একটি মেসেজও। যদিও এটি মনে হয় প্রয়োজনীয়, কিন্তু অনেক সময় এটি অতিরিক্ত হয়ে পড়ে এবং মানসিক চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

ইউনিভার্সিটি অফ ক্যালিফোর্নিয়ার মনোবিজ্ঞানী ডা. ইমানুয়েল মেইডেনবার্গ বলছেন, “মানুষ সচেতনভাবে ডিজিটাল সঞ্চয়ের মাধ্যমে উদ্বেগ কমানোর চেষ্টা করে, কিন্তু যদি এটি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায়, তবে এটি অন্য ধরনের মানসিক চাপ সৃষ্টি করে।”

অন্যদিকে, ‘ডিজিটাল সঞ্চয়’ যখন অতিরিক্ত হয়ে ওঠে, তখন তা “প্রতিদিনের জীবনে চাপ সৃষ্টি করতে পারে।” বস্টন ভিত্তিক ইন্টারন্যাশনাল ওসিডি ফাউন্ডেশন-এর মনোবিজ্ঞানী ডা. সঞ্জয় সাক্সেনা বলেছেন, “ডিজিটাল জঞ্জাল এমন এক ধরনের সমস্যা, যা বিশ্বের ৩-৫% জনসংখ্যার মধ্যে দেখা যায় এবং এটি মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য এক ধরনের হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।”

ডিজিটাল জঞ্জাল মানসিক চাপ সৃষ্টি করলেও এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। সঠিক পদ্ধতিতে এই সমস্যা মোকাবেলা করলে আপনি সহজেই মানসিক শান্তি ফিরে পেতে পারেন। নিচে কিছু কার্যকরী পরামর্শ দেওয়া হলো:

১। প্রতিদিনের কাজের মধ্যে সময় নির্ধারণ করুন: যদি আপনার কাছে পর্যাপ্ত সময় না থাকে, তবে প্রতিদিনের মধ্যে মাত্র কয়েক মিনিট দিন ডিজিটাল জঞ্জাল পরিষ্কার করার জন্য। খালি করার জন্য অপ্রয়োজনীয় ইমেইল, স্ক্রিনশট বা ফাইল ডিলিট করতে পারেন।

২। নোটিফিকেশন ও বিজ্ঞাপনগুলো বন্ধ করুন: সেই সব বিজ্ঞাপনভিত্তিক ইমেইল বা পেইজের ‘আনসাবস্ক্রাইব’ করুন, যেগুলি আপনার দৃষ্টিকে অন্য দিকে সরিয়ে নিয়ে যায়। এটি আপনার মনোযোগকে এক জায়গায়集中 করতে সাহায্য করবে।

৩। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ন্ত্রণ করুন: সোশ্যাল মিডিয়ার প্রতি অতিরিক্ত আগ্রহ আমাদের মনোযোগ হরণের প্রধান কারণ হতে পারে। তাই সামাজিক মাধ্যম বা ইমেইলের নোটিফিকেশন বন্ধ করে বা সাইলেন্ট মোডে রেখে এই চাপ কমানো যায়।

৪। ডিজিটাল ডিটক্স দিন: প্রতিদিন কিছু সময় ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বিরত থাকার চেষ্টা করুন। একেবারে ‘ডিজিটাল বিষমুক্ত দিবস’ পালন করতে পারেন, যেখানে আপনি ফোন, কম্পিউটার বা অন্যান্য ডিজিটাল ডিভাইস থেকে দূরে থাকবেন।

৫। ব্যক্তিগত নিয়ম তৈরি করুন: অন্তত প্রতি সপ্তাহে একদিন এমন কিছু নিয়ম তৈরি করুন, যাতে আপনি ডিজিটাল জঞ্জাল কমিয়ে নিজের মানসিক শান্তি বজায় রাখতে পারেন।

ডিজিটাল যুগে জীবন অনেক সহজ হলেও, এর সঙ্গে এসে পৌঁছানো ডিজিটাল জঞ্জাল আমাদের জীবনে এক অপ্রত্যাশিত চাপ সৃষ্টি করতে পারে। তবে সচেতনতা ও সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে আপনি এই চাপ কমাতে পারেন এবং আপনার মানসিক স্বাস্থ্যের উন্নতি করতে পারেন। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারই সঠিকভাবে চলতে সাহায্য করে, তবে একে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে জানতে হবে। ডিজিটাল জঞ্জাল পরিষ্কার করার মাধ্যমে আপনি শুধু প্রযুক্তির সুবিধা উপভোগ করবেন না, বরং নিজের মানসিক শান্তিও ফিরে পাবেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *