বাংলাদেশি পেসার মুস্তাফিজুর রহমান, যিনি নিজের দুর্দান্ত কাটার এবং বৈচিত্র্যময় বোলিং দিয়ে আন্তর্জাতিক ও ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খ্যাতি অর্জন করেছেন, এবার আইপিএল ২০২৪ নিলামে অবিক্রিত থেকে গেছেন। তার দল না পাওয়া নিয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেটপ্রেমীদের মধ্যে হতাশা ও প্রশ্নের ঝড় উঠেছে। মুস্তাফিজের দল না পাওয়ার কারণ হিসেবে উঠে এসেছে তার সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স, ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের কৌশল এবং কিছু অক্রিকেটীয় প্রভাব।
২০১৬ সালে সানরাইজার্স হায়দরাবাদের হয়ে আইপিএল অভিষেকেই চমক দেখিয়েছিলেন মুস্তাফিজ। সেই মৌসুমে ১৭ ম্যাচে ১৭ উইকেট নিয়ে দলের শিরোপা জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন তিনি। সেই সাফল্যের পরপরই আইপিএলের অন্যতম সেরা বিদেশি পেসার হিসেবে তার নাম ছড়িয়ে পড়ে। তবে এরপরের মৌসুমগুলোতে পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতা রাখতে পারেননি।
রাজস্থান রয়্যালস, মুম্বাই ইন্ডিয়ান্স, দিল্লি ক্যাপিটালস এবং সর্বশেষ চেন্নাই সুপার কিংসের হয়ে খেললেও মুস্তাফিজ কখনও দীর্ঘ সময়ের জন্য একটি দলে স্থায়ী হতে পারেননি। বিশেষ করে গত মৌসুমে চেন্নাইয়ের হয়ে ৯ ম্যাচে ১৪ উইকেট নেওয়ার পরও এবার তাকে কোনো ফ্র্যাঞ্চাইজি কেন দলে নেয়নি, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।
২০২৩ সালে মুস্তাফিজ চেন্নাই সুপার কিংসের ঘরের মাঠ চিদাম্বরামে দুর্দান্ত বোলিং করেছিলেন। ৬ ম্যাচে তিনি নিয়েছিলেন ১১ উইকেট। তবে অন্যান্য ভেন্যুতে, বিশেষ করে স্পোর্টিং উইকেটগুলোতে, তার পারফরম্যান্স ছিল হতাশাজনক। সেই মৌসুমের চেন্নাইয়ের বাইরে খেলা তিন ম্যাচে তিনি ১৪৫ রান দিয়ে মাত্র তিনটি উইকেট নিয়েছিলেন। এর মানে হলো, ঘরের মাঠে দুর্দান্ত হলেও, বাইরের ভেন্যুতে মুস্তাফিজ ছিলেন বড্ড অসহায়।
ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য এই ধরণের একপেশে পারফরম্যান্স একজন বোলারকে দলে টানার ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাছাড়া, আইপিএলের মতো প্রতিযোগিতামূলক আসরে ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলো এমন বোলারকেই বেশি প্রাধান্য দেয়, যারা মাঠের অবস্থান অনুযায়ী দ্রুত নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে।
২০২৪ সালের আইপিএল নিলামের ‘অ্যাক্সিলারেটেড রাউন্ডে’ মুস্তাফিজের নাম উঠেছিল। তবে তার ভিত্তিমূল্য ছিল ২ কোটি রুপি। নিলামের এই পর্যায়ে বেশিরভাগ দলই তাদের প্রয়োজনীয় খেলোয়াড় দলে ভিড়িয়ে ফেলেছিল। ফলে বিদেশি খেলোয়াড়ের জন্য বড় অঙ্কের বাজেট রাখতে পারেনি। তার ওপর মুস্তাফিজের সাম্প্রতিক সময়ের ফর্ম এবং পুরো মৌসুম খেলতে না পারার ইতিহাস তার প্রতি ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর আস্থা কমিয়েছে।
বিসিবির ভূমিকা মুস্তাফিজসহ অন্যান্য বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের আইপিএল যাত্রায় অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হিসেবে কাজ করেছে। অতীতে বিসিবি প্রায়শই নিজেদের খেলোয়াড়দের আইপিএলের মাঝপথে ফিরিয়ে এনেছে জাতীয় দলের খেলার জন্য। এমনকি তুলনামূলক দুর্বল প্রতিপক্ষ, যেমন আয়ারল্যান্ড বা জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সিরিজেও খেলোয়াড়দের ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে।
ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কাছে এটি একটি বড় সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। আইপিএল একটি দীর্ঘ প্রতিযোগিতা এবং পুরো মৌসুম জুড়ে একজন খেলোয়াড়ের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলে, তাকে দলে নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ। গত মৌসুমে চেন্নাই সুপার কিংস এমন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিল, যখন মাঝপথে মুস্তাফিজকে দেশে ফিরতে হয়। তার অনুপস্থিতি পূরণে তাদের বিকল্প বোলার ব্যবহার করতে হয়েছিল, যা দলীয় পারফরম্যান্সে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছিল।
ভারতীয় গণমাধ্যমের কিছু অংশ দাবি করেছে, মুস্তাফিজের দল না পাওয়ার পেছনে রাজনীতিও ভূমিকা রেখেছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের টানাপোড়েনের কারণে উভয় দেশের মধ্যে বিরূপ মনোভাব তৈরি হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের দলে নেওয়া ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর জন্য একটি স্পর্শকাতর বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
এছাড়া, ভারতের কিছু স্থানীয় খেলোয়াড়কে গুরুত্ব দেওয়া এবং বিদেশি পেসারদের উপর নির্ভরশীলতা কমানোর পরিকল্পনাও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর কৌশলের অংশ।
মুস্তাফিজুর রহমানের মতো প্রতিভাবান বোলারের জন্য আইপিএলের দরজা চিরতরে বন্ধ নয়। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ধারাবাহিকভাবে ভালো পারফরম্যান্স দেখিয়ে তিনি আবারও ফ্র্যাঞ্চাইজিগুলোর মনোযোগ আকর্ষণ করতে পারেন। একইসঙ্গে বিসিবির পক্ষ থেকে ক্রিকেটারদের ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে খেলার বিষয়টি আরও পেশাদারভাবে ব্যবস্থাপনা করা হলে, ভবিষ্যতে এই সংকট কাটানো সম্ভব।
মুস্তাফিজের দল না পাওয়ার ঘটনা শুধুমাত্র একজন খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারের প্রশ্ন নয়, বরং এটি বাংলাদেশের ক্রিকেটারদের আইপিএলে অংশগ্রহণের সামগ্রিক চিত্রকে প্রতিফলিত করে। পারফরম্যান্সের পাশাপাশি বিসিবির নীতিমালা এবং রাজনৈতিক প্রভাব এই সমস্যাকে আরও জটিল করে তুলেছে। তবে মুস্তাফিজুর রহমান যেভাবে প্রতিকূল পরিস্থিতি মোকাবিলা করে নিজের জায়গা বারবার ফিরে পেয়েছেন, এবারও তিনি ঠিকই ঘুরে দাঁড়াবেন বলে বিশ্বাস রাখেন তার ভক্তরা।